ভাতের মাড়ের উপকারিতা

ভাত বাঙালি জাতির সাথে খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। কথায় আছে, আমরা ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। ভাত ছাড়া আমাদের দিন যেনো শুরুই হয় না। শুধু বাংলাদেশ তথা বাঙালিদের কাছেই না, গত কয়েক দশকে সারা বিশ্বেই ভাতের জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি হোক কী ক্রেমলিন, সুমাত্রা হোক কী সিডনি, বিশ্বের নানা প্রান্তে ভাতকে কেন্দ্র করে নানা পদ তৈরি হচ্ছে এবং নানা ভাষা, নানা জাতির মানুষ তা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণও করছেন।

তবে এই ভাতের সাথে আরো গভীরভাবে যে জিনিসটা মিশে আছে তার সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। তা হলো ভাতের মাড়। আমরা সাধারনত ভাত রান্নার পর মাড়টা ফেলে দেই। এতে চালের যা গুণাগুণ তার সিংহভাগই সেই পানির সঙ্গে চলে যায়। যার ফলে ভাতের সঙ্গে যে পরিমাণ পুষ্টি আমাদের শরীরে প্রবেশ করা উচিত, তা করছে না। 

গবেষণায় দেখা গেছে শরীর এবং ত্বককে চাঙ্গা রাখতে ভাতের মাড়ের কোনো বিকল্প হয় না। ভাতের মাড়ে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খনিজ, ভিটামিন ই সহ আরও বেশ কিছু কার্যকরী উপাদান আমাদের শরীর গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এমনকি একাধিক রোগের উপশমেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে এই ভাতের মাড়।

প্রসঙ্গত, একাধিক প্রাচীন গ্রন্থেও এই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানেও ভাতের মাড়কে কাজে লাগিয়ে শরীরকে রোগমুক্ত রাখা যায়, সে নিয়ে অনেক কিছু লেখা রয়েছে। এই লেখায়ও আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রাচীন শাস্ত্রকে মিলিয়ে ভাতের মাড়ের এমন কিছু উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে, যা আপনাকেও অবাক করবে।

ভাতের মাড়ের উপকারিতা

চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে

গোসলের আগে ভাতের মাড় ভাল করে চুলে লাগান। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর হালকা গরম পানি দিয়ে চুলটা ধুয়ে ফেলুন। এতে চুলের গোড়ায় পুষ্টির অভাব দূর হবে। ফলে চুল পড়া সহ একাধিক স্কাল্প সম্পর্কিত রোগের প্রকোপ কমতে শুরু করবে। সেই সঙ্গে চুলের উজ্জ্বলতাও বাড়বে।

ত্বককে সুন্দর করে

মাড়কে প্রাকৃতিক টোনারও বলা যেতে পারে। বেশ কিছু কেস স্টাডি করার সময় গবেষকরা লক্ষ করেছেন, প্রতিদিন মুখে ভাতের মাড় লাগিয়ে ম্যাসেজ করলে ত্বকের ছিদ্র ছোট হয়, সেই সঙ্গে স্কিনের উপরিঅংশে জমে থাকা মৃত কোষের আবরণ সরে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ত্বক সুন্দর হয়ে ওঠে। 

প্রসঙ্গত, রাতে শুতে য়াওয়ার আগে একটা তুলোর সাহায্যে ভাতের মাড় সারা মুখে লাগিয়ে ভাল করে ম্যাসেজ করে সারা রাত রেখে দিন। সকালে উঠে মুখটা ধুয়ে নিন। এমনটা রোজ করলেই দেখবেন ত্বক নিয়ে আর কোনও চিন্তা থাকবে না।

ব্রণের প্রকোপ কমায়

প্রতিদিন দুবার করে ভাতের মাড় ভাল করে মুখে লাগালে ব্রণ কমতে শুরু করে। কারণ এতে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান ত্বকের অন্দরে প্রদাহের মাত্রা হ্রাস করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্রণ কমে যায়।

ডায়ারিয়ার চিকিৎসায় কাজে লাগে

পানির মতো পায়খানা হলে, সেই সঙ্গে পেটে এমন ব্যথা যে আত্মারাম খাঁচা হওয়ার যোগাড়! তাহলে এখন থেকেই ভাতের মাড় খাওয়া শুরু করুন। দেখবেন উপকার মিলবে। আসলে পেট খারাপের সময় এক গ্লাস ভাতের মাড়ে অল্প লবণ দিয়ে খেলে শরীরে উপকারী খনিজের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। ফলে রোগের প্রকোপ কমতে শুরু করে।

এনার্জির ঘাটতি দূর করে

শরীরচর্চার আগে এক গ্লাস ভাতের মাড় খেলে শরীরে ৮টি উপকারী অ্যামাইনো এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা এক্সারসাইজের সময় পেশির গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই সঙ্গে ভাতের মাড়ে উপস্থিত কার্বোহাড্রেট এনার্জির ঘাটতি দূর করতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত ২ গ্লাস করে ভাতের মাড় খাওয়ার অভ্যাস করলে বাওয়েল মুভমেন্টে উন্নতি ঘটে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোষ্ঠকাঠিন্যের উপশম ঘটতে শুরু করে।

ভাতের মাড়ের পুষ্টিগুণ 

ভাতের মাড়ে থাকে হরেক রকম পুষ্টিমান। গবেষণায় দেখা গেছে, ভাতের মাড়ে উল্লেখযোগ্য হারে ভিটামিন বি এবং ভিটামিন ই রয়েছে। এছাড়া এতে রয়েছে আমিষ, শর্করা, লৌহ, ফসফরাস ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান।

আমরা মাড় নিয়ে না ভাবলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। চীনা বিজ্ঞানী মি. লিন ফেলে দেয়া ভাতের মাড় নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, ভাতের মাড়ে ক্যালসিয়াম, লৌহ, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, মেলেনিয়াম-এ ছয়টি উপাদান রয়েছে।

তিনি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন মাড়ের মধ্যে লৌহ ১০ গুণ, ক্যালসিয়াম ৪ গুণ, ম্যাঙ্গানিজ ১২ গুণ, কপার ৬ গুণ ও মেলেনিয়াম ২ গুণ রয়েছে। এছাড়াও আছে টোকোট্রাইনোল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান। মাড়ের সাথে পুষ্টির অপচয় : আমাদের দেশে প্রচলিত নিয়মে মাড় নিংড়িয়ে ফেলে দেয়ার কারণে পুষ্টির মারাত্মক অপচয় হয়। আমরা যদি জানতাম কী পরিমাণ পুষ্টি মাড়ের সাথে চলে যায় তাহলে হয়তো কখনো এ অপচয় করতাম না।

আসুন দেখে নেই মাড় নিংড়ানোর দরুণ কী পরিমাণ পুষ্টিহানি হয়ে থাকে : পুষ্টি উপাদান এবং মাড় নিংড়ানোজনিত পুষ্টিহানি (শতকরা) ক্যালরি ১৫%, আমিষ ১৫%, শর্করা ১০%, লৌহ ৫০%, ফসফরাস ৫০%, আয়োডিন ৪০%, রিবোফ্লোভিন ২৫%, নায়াসিন ২৩% এবং ক্যালসিয়াম ৫০%।

ভাতের মাড়ের অপকারিতা

ভাতের মাড়ের সাথে ৪৮% শর্করা চলে যায়। ভাতের মাড় খেলে এ শর্করা পাওয়া যাবে। এটা খেলে ক্ষতি তেমন হয় না। তবে বেশী খেলে পেটে সমস্যা হতে পারে। অনেকে ভাত রান্না করে ভাতের মাড় ফেলে দেন। ফেলে না দিয়ে খেয়ে ফেলুন উপকারেই পাবেন বেশি। 

নবীনতর পূর্বতন