গ্রিন টি এর উপকারিতা, পুষ্টিগুণ, এবং অপকারিতা

গ্রিন টি এর উপকারিতা

কমবেশি আমরা সবাই চা খুব পছন্দ করি। আমাদের শরীরের জন্য গ্রিন টি অনেক উপকারী, এ কথা কমবেশি সবারই জানা। পানীয় হিসেবে চা-কফির পাশাপাশি গ্রিন টি অনেক বেশি পরিচিত সব জায়গাতেই। তবে অনেকেই মনে করে থাকেন যে, এটি শুধু ওজন কমাতে খাওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ওজন কমানোর সমাধানসহ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও এটি অনেক উপকারী। আজেকের এই পোস্টে আমরা আপনাদের গ্রীন টি নিয়ে যাবতীয় আলোচনা করবো। 

গ্রিন টি এর উপকারিতা 

শরীরকে সতেজ রাখে

গ্রিন টিতে ফ্লেভোনয়েড নামের একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে। আর এটি হচ্ছে— শরীরকে সতেজ রাখে এমন একটি শক্তিশালী উপাদান। তাই গ্রিন টি খেলে শরীর থাকে সতেজ।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে গ্রিন টি। এতে কেটেচিন নামের একটি উপাদান থাকে এবং এটি ভিটামিন ই ও সির থেকেও বেশি শক্তিশালী। তাই গ্রিন টি খেলে তা শরীরে প্রবেশ করে অনেক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশপাশি বিভিন্ন উপকার করে।

অ্যালার্জিসহ নানা রোগে উপকারী

গ্রিন টি অ্যালার্জির সমস্যা সমাধানে অনেক উপকারী। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, হার্টঅ্যাটাকের সম্ভাবনা কমানো, ক্যানসার প্রতিরোধ, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে গ্রিন টি।

ডিপ্রেশন কমায়

গ্রিন টি অবসাদ বা ডিপ্রেশন কমাতেও অনেক কার্যকরী। এতে থিয়ানিন নামের অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকার কারণে এটি ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে। তাই ডিপ্রেশন কমাতে নিয়মিত গ্রিন টি খেতে পারেন।

ওজন কমায়

গ্রিন টির সবচেয়ে পরিচিত গুণাবলি হচ্ছে— এটি ওজন কমাতে কার্যকরী। মূলত এটি হজম প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধি করে শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া এতে থাকা কেটাচিনও পেটের মেদ কমাতে সাহায্য করে।

দাঁত ভালো রাখে

গ্রিন টিতে থাকা ক্যাটেকাইন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দাঁত ভালো রাখতে অনেক উপকারী। এ উপাদানটি মুখের ভেতরের ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে রোধ করে। ফলে এটি গলার বিভিন্ন সংক্রমণ রোধ করাসহ দাঁত ভালো রাখতে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে

সবুজ চা দৃশ্যত রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ে, যা প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে গ্রিন টি।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্রিন টি শরীরের প্রতিটি শিরায় কাজ করে। ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। তাই কোনো কারণে রক্ত চাপে পরিবর্তন হলেও কোন ধরনের ক্ষতি করে না। তাছাড়া এই চা রক্ত জমাট বাধতে দেয় না। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভবনা অনেক কমে যায়।

খাদ্যনালীর ক্যান্সার রোধ

এটা খাদ্যনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও ভালো কোষগুলোর কোনো ক্ষতি না করে সার্বিকভাবে ক্যান্সারের কোষ নির্মূল করে।

কলেস্টেরল

গ্রিন টি শরীরের ক্ষতিকর কলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকারী কোলেস্টেরলের পরিমাণও বাড়ায়।

রক্ত চাপ কমায়

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে ।

এন্টি-ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়া বিরোধী

সবুজ চা ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত সব রকমের রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এটা ক্যান্সারের ধ্বংসাত্মক সেল ধ্বংস করে। চায়ের ক্যাটেকাইন উপাদান অ্যান্টি ভাইরাল ও অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল হিসেবে বেশ কার্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক রোগ বিস্তারেও বাধা দেয় গ্রিন টি।

ত্বকের যত্নে গ্রীন টি

গ্রীন টি তে রয়েছে এক ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট যা বার্ধক্যের গতিকে ধীর করে এবং আয়ু বাড়ায়। চোখের ফোলা ভাব এবং চোখের নীচের ডার্ক সার্কেল কমাতে ব্যবহার করা গ্রীন টি এর দুটি ব্যাগ ২ ঘন্টা ফ্রীজে রেখে, ঠান্ডা করে চোখ বন্ধ করে এর উপর ১০ মিনিট রাখুন। তাছাড়া এটি ত্বকের রোদে পোড়াভাব কমাতে ও ব্ল্যাক হেডস দূর করতে সাহায্য করে। গ্রীন টি খুব ভালো টোনার হিসেবে কাজ করে।

১ কাপ গ্রিন টি পুষ্টিগুণ 

  • মোট ফ্যাট 0 গ্রাম
  • সোডিয়াম 2.5 মিলিগ্রাম
  • মোট কার্বোহাইড্রেট 0 গ্রাম
  • খাদ্যতালিকাগত ফাইবার 0 গ্রাম
  • চিনি 0 গ্রাম
  • প্রোটিন 0.5 গ্রাম
  • ভিটামিন ডি 0.00 এমসিজি
  • ক্যালসিয়াম 0.00 মিলিগ্রাম
  • আয়রন 0.05 মিলিগ্রাম
  • পটাসিয়াম 20 মিলিগ্রাম

গ্রিন টি এর অপকারিতা

এটি বেশি খেলে পাকস্থলীতে অ্যাসিড তৈরি হতে শুরু করে এবং এতে ডায়রিয়ার ঝুঁকিও দেখা দেয়। যাঁদের বাওয়েল সিনড্রোম রয়েছে তাঁদের একেবারেই গ্রিন টি খাওয়া উচিত নয়। খুব বেশি গ্রিন টি খেলে মাথা যন্ত্রণা হতে পারে। কারণ এতে থাকা ক্যাফেইন মাইগ্রেনের সমস্যা তৈরি করে। তবে সবকিছু পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই শ্রেয়। 

ওজন কমাতে গ্রিন টি খাওয়ার নিয়ম

সবচেয়ে বেশি উপকার পেতে হলে কোনও ভারী খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে কিংবা ২ ঘণ্টা পরে গ্রিন টি খেতে পারেন। এই চায়ে ক্যাফিন ও ক্যাটেচিন ভাল মাত্রায় থাকে, এই যৌগগুলি বিপাকহার বাড়াতে সাহায্য করে। তাই ওজন ঝরানোর জন্য গ্রিন টি খেতে হলে খাবারের মাঝে খাওয়াই শ্রেয়। খালি পেটে খেলে তেমন উপকার পাবেন না।

গ্রিন টি খাওয়ার সময়

বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রিন টি খেতে হলে দুটি ভারী খাবারের মাঝখানের বিরতিতেই খাওয়া উচিত। সবচেয়ে বেশি উপকার পেতে হলে কোনও ভারী খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে কিংবা ২ ঘণ্টা পরে গ্রিন টি খেতে পারেন। এই চায়ে ক্যাফিন ও ক্যাটেচিন ভাল মাত্রায় থাকে, এই যৌগগুলি বিপাকহার বাড়াতে সাহায্য করে।

গ্রিন টি বানানোর নিয়ম

পানি গরম করে ফুটে গেলে (৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জল থাকলে ভাল।) তারপর তা সামান্য ঠান্ডা হলে স্টিল বা কাচের পাত্রে রাখতে হবে। তার পর এতে চা পাতা যোগ করে ৩ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। চা পাতা পুরোপুরি ভিজে গেলে পছন্দের কাপে চা ছেঁকে চুমুক দিন প্রিয় পানীয়তে।

আসল গ্রিন টি চেনার উপায়

পাতার আকার

সাধারণত গ্রিন টি টি ব্যাগ আকারে কিনতে পাওয়া যায়, যা একদমই অরিজিনাল না। খাঁটি গ্রিন টি শুকনো পাতা হিসেবেই বিক্রি হয়। টি ব্যাগের চাইতে শুকনো পাতা স্বাদে ও মানে উন্নত থাকে। পাতার আকার দেখে কিনলে বিভ্রান্তি থেকে অনেকাংশেই বাঁচা সম্ভব।

প্রচলিত গ্রিন টি ব্যাগে অত্যধিক শুকনো ছোট ছোট কালো বা কালচে সবুজ রঙের পাতার টুকরা থাকে। আসল চা টি ব্যাগ ছাড়া কিনতে পাওয়া যায়৷ বেশিরভাগ সময়ে গাছের একদম কচি পাতা থেকে গ্রিন টি আসে। মাঝে মাঝে কচি পাতার পাশাপাশি উপরের দিকের কয়েকটি পাতা ব্যবহৃত হয়।

পাতার রং

গ্রিন টি গ্রিন হয় অক্সিডেশন বা ফারমেন্টেশনের অভাবে। এতে চা পাতা কালচে বা বাদামি হয়ে যায় না। ব্ল্যাক টি বা কালো চা কালো দেখায় কারণ চা পাতাকে ফারমেন্টেশনের আওতায় আনা হয়। অক্সিডেশনে না থাকলে চা পাতার ক্লোরোফিল অটুট থাকে এবং গ্রিন টি সবুজ দেখায়।

গ্রিন টি সবুজ রঙ

বাগান থেকে পাতা তুলে সরাসরি তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে শুকিয়ে গ্রিন টি করা হয়৷ আসল গ্রিন টি চিনতে চাইলে চা পাতার রং খেয়াল করুন। বাজারে গ্রিন টি বেশ চটকদার করে উপস্থাপন করা হয়। সেটি দেখতে মোটেও সবুজ লাগে না। অরিজিনাল গ্রিন টি দেখতে উজ্জ্বল, হালকা সবুজ রঙের হয়।

অনুভূতি

গ্রিন টি-র পাতা হাতে ধরে অরিজিনালিটি ও ফ্রেশনেস শনাক্ত করা সম্ভব। কিভাবে? চেক করে দেখুন পাতাটি আস্ত আছে কিনা এবং ধরতে মসৃণ কিনা। যদি পাতাটা ভাঙা বা কাটা থাকে, হাতের আলতো ছোঁয়ায় দুমড়ে যায় বা মুচমুচে হয়ে ভেঙে যায়, তাহলে বুঝবেন সেটি অনেক পুরনো কিংবা বেশি শুকানো হয়েছে।

চায়ের কোয়ালিটি ঠিক রাখতে হলে এমনভাবে তাপ দিতে হয় যেন শুকানোর পরেও মসৃণতা অটুট থাকে। অরিজিনাল, ফ্রেশ গ্রিন টি-র পাতায় গরম জল পড়লে আস্তে আস্তে মেলতে শুরু করে৷ যখন গ্রিন টি কিনবেন তখন হাতে কাটা চা পাতা দেখে কেনার চেষ্টা করুন। ভঙ্গুর, ছাতা পড়া পাতা কেনা বিরত থাকুন।

প্রক্রিয়াজাতকরণ

নকল গ্রিন টি রাসায়নিক ও কীটনাশক দিয়ে মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে ক্ষতিকর ধুলাবালি ও উপাদানের পরিমাণও বেশি থাকে৷ আবার টি ব্যাগে ঢোকানোর কারণে চা পাতার পুষ্টিগুণ অনেকটা নষ্ট হয়। টি ব্যাগের ফিল্টার পেপারটা অনেক সময় স্বাস্থ্যসম্মত হয় না।

আসল গ্রিন টি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় না বললেই চলে। করা হলেও তাতে কৃত্রিম ও ক্ষতিকর উপাদান খুব কম থাকে। খাঁটি চায়ের প্যাকেটে এপিগ্যালোক্যাটেচিন লেখা থাকে, যেটা নকল চায়ের মোড়কে থাকবে না।

স্বাদ ও গন্ধ

স্বভাবতই আসল গ্রিন টি-র স্বাদ ও গন্ধ নকলটির চাইতে আলাদা হবে। নকল চা খেতে স্বাদ লাগবে না, কোন উপকারও হবে না। আসল গ্রিন টি-র স্বাদ একদম আলাদা, মুখে দিলে বিভিন্ন রকমের স্বাদ পাওয়া যাবে। স্মুদিনেসের সাথে আসবে সতেজতা, চনমনে ভাব।

গন্ধের দিক থেকেও আসল গ্রিন টি সেরা৷ গরম জলের সংস্পর্শে আসলে কচি ঘাসের মতো হালকা এবং সতেজ ঘ্রাণ আসবে। আবার আসল গ্রিন টি তে বিদ্যমান এসেনশিয়াল অয়েল চা বানানোর পরে অটুট থাকে।

আসল চা যত দিন যাবে তত স্বাদ নষ্ট হতে থাকবে। কিন্তু নকল চা মাসের পর মাস গেলেও স্বাদ ও গন্ধ একইরকম থাকবে। আপনার কেনা গ্রিন টি যদি বানানোর পরে তেঁতো, পানসে, বা একঘেয়ে স্বাদ পান, গন্ধটাও যদি হয় সেরকম, বুঝে নিবেন নকল বা লো কোয়ালিটির চা কিনেছেন।

চায়ের রং

আগেই বলেছি আসল চা পাতার রং অসাধারণ হবে। সেটি ছিল কাঁচা অবস্থার কথা। এবারে জানুন চা ফোটানোর পরে রংয়ের পরিবর্তন কিরকম হবে সে সম্পর্কে। অরিজিনাল গ্রিন টি পাতা গরম জলে প্রথমে জলপাই সবুজ রং ধারণ করবে। কিছুক্ষণ পরে রং পরিবর্তন হয়ে হালকা সবুজ রংয়ে ফেরত আসবে, যেমনটি কাঁচা পাতার ছিল৷ যেসব গ্রিন টি-র প্রসেসিংয়ে ত্রুটি থাকে, সেগুলো ফোটানোর পরে বাদামি বা কালচে হয়ে যায়। পরবর্তীতে রংয়ের পরিবর্তন হয় না।

চা পাতার মেয়াদ

গ্রিন টি কেনার ক্ষেত্রে মেয়াদ হচ্ছে বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি ব্যাপার। সাধারণত এই চায়ের চাষ হয় প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে। উৎপাদনকৃত চা উৎপাদনের সময় থেকে ৬-১২ মাসের বেশি রাখা যায় না। আসল উৎপাদনকারী বা বাগানীদের কাছ থেকে সরাসরি চা কিনলে মেয়াদ ঠিক থাকে।

কিন্তু দোকানের চা-তে মেয়াদ ঠিক থাকে না। প্যাকেটের গায়ে যে মেয়াদটা লেখা থাকে সেটি আসলে রি-সেলার কবে চা প্যাকেটজাত করেছে সেই তারিখ। রি-সেলারের কাছে পৌঁছানোর আগে গ্রিন টি কয়েক হাত ঘুরে আসে। যতদিনে রি-সেলার বা খুচরা ব্যবসায়ীর হাতে আসে, ততদিনে চায়ের মেয়াদ শেষের কোঠায় চলে যায়। তখন বিক্রির জন্য বাধ্য হয়ে বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে, মেশিনে প্রসেস করে চায়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়।

তাই অরিজিনাল গ্রিন টি কিনতে চাইলে বাগানের খোঁজ করুন। বাগানী কবে চা তুলে প্রসেস করেছে এবং তা কতদিন পর্যন্ত ভালো থাকবে এসব সম্পর্কে সঠিক তথ্য মোড়কে পাবেন।

Next Post Previous Post