হুমায়ুন আহমেদ এর জননন্দিত সব কবিতা

হুমায়ুন আহমেদ এর কবিতা

বাংলা সাহিত্যের জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ । ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' দিয়েই হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্যে পালাবদলের তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। একের পর জনপ্রিয় উপন্যাস রচনা করে গেছেন।

হুমায়ুন আহমেদ এর কবিতা

বাবার চিঠি

হুমায়ূন আহমেদ

আমি যাচ্ছি নাখালপাড়ায়।

আমার বৃদ্ধ পিতা আমাকে পাঠাচ্ছেন তাঁর

প্রথম প্রেমিকার কাছে।

আমার প্যান্টের পকেটে সাদা খামে মোড়া বাবার লেখা দীর্ঘ পত্র।

খুব যত্নে খামের উপর তিনি তাঁর প্রণয়িনীর নাম লিখেছেন।

কে জানে চিঠিতে কি লেখা – ?

তাঁর শরীরের সাম্প্রতিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা ?

রাতে ঘুম হচ্ছেনা, রক্তে সুগার বেড়ে গেছে

কষ্ট পাচ্ছেন হাঁপানিতে – এইসব হাবিজাবি। প্রেমিকার কাছে

লেখা চিঠি বয়সের ভারে প্রসঙ্গ পাল্টায়

অন্য রকম হয়ে যায়।

সেখানে জোছনার কথা থাকে না,

সাম্প্রতিক শ্বাসকষ্ট বড় হয়ে উঠে।

প্রেমিকাও একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর

রোগভুগের কথা পড়তে ভালবাসেন।

চিঠি পড়তে পড়তে দরদে গলিত হন –

আহা, বেচারা ইদানিং বড্ড কষ্ট পাচ্ছে তো …  


সংসার

হুমায়ূন আহমেদ

শোন মিলি।

দুঃখ তার বিষমাখা তীরে তোকে

বিঁধে বারংবার।

তবুও নিশ্চিত জানি,একদিন হবে তোর

সোনার সংসার ।।

উঠোনে পড়বে এসে একফালি রোদ

তার পাশে শিশু গুটিকয়

তাহাদের ধুলোমাখা হাতে – ধরা দেবে

পৃথিবীর সকল বিস্ময়।


বাসর

হুমায়ূন আহমেদ

কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে তার সঙ্গে দেখা ।

লোহার তৈরি ছোট্ট একটা ঘর ।

বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোন যোগ নেই ।

ঘরটা শুধু উঠছে আর নামছে ।

নামছে আর উঠছে ।

মানুষ ক্লান্ত হয় –

এ ঘরের কোন ক্লান্তি নেই।

এ রকম একটা ঘরেই বোধহয় বেহুলার বাসর হয়েছিল ।

নিশ্ছিদ্র লোহার একটা ঘর ।

কোন সাপ সেখানে ঢুকতে পারবে না ।

হিস হিস করে বলতে পারবে না, পাপ করো। পৃথিবীর সব আনন্দ পাপে ।

পুণ্য আনন্দহীন । উল্লাসহীন ।

পুণ্য করবে আকাশের ফিরিশতারা ।

কারণ পুণ্য করার জন্যেই তাদের তৈরি করা হয়েছে ।

লোহার সেই ঘরে ঢোকার জন্য সাপটা পথ খুঁজছিলো ।

সেই ফাঁকে বেহুলা তাঁর স্বামীকে বললেন, কি হয়েছে, তুমি ঘামছ কেন ?

আর তখন একটা সুতা সাপ ঢুকে গেলো।

ফিসফিস করে কোন একটা পরামর্শ দিতে গেলো ।

বেহুলা সেই পরামর্শ শুনলেন না বলেই কি লখিন্দরকে মরতে হল ?

 তার সঙ্গে আমার দেখা কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে ।

ঘরটা শুধু ওঠে আর নামে ।

আমি তাকে বলতে গেলাম – আচ্ছা শুনুন, আপনার কি মনে হচ্ছে না

এই ঘরটা আসলে আমাদের বাসর ঘর ?

আপনি আর কেউ নন, আপনি বেহুলা ।

যেই আপনি ভালবেসে আমাকে কিছু বলতে যাবেন

ওম্নি একটা সুতা সাপ এসে আমাকে কামড়ে দেবে ।

আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন । দয়া করে কিছু বলবেন না ।


গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না

হুমায়ূন আহমেদ

প্রতি পূর্নিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই

গৃহত্যাগী হবার মত জ্যোৎস্না কি উঠেছে ?

বালিকা ভুলানো জ্যোৎস্না নয়।

যে জ্যোৎস্নায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছুটাছুটি করতে করতে বলবে-

ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ !

নবদম্পতির জ্যোৎস্নাও নয়।

যে জ্যোৎস্না দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন-

দেখ দেখ নীতু চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর !

কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জ্যোৎস্না নয়।

যে জ্যোৎস্না বাসি স্মৃতিপূর্ন ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।

কবির জ্যোৎস্না নয়। যে জ্যোৎস্না দেখে কবি বলবেন-

কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ !

আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার জন্য বসে আছি।

যে জ্যোৎস্না দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে-

ঘরের ভেতরে ঢুকে পরবে বিস্তৃত প্রান্তর।

প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব-

পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।

চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়।


তিনি

হুমায়ূন আহমেদ

এক জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ ছিলেন নিজ মনে

আপন ভুবনে।

জরার কারণে তিনি পুরোপুরি বৃক্ষ এক।

বাতাসে বৃক্ষের পাতা কাঁপে

তাঁর কাঁপে হাতের আঙ্গুল।

বৃদ্ধের সহযাত্রী জবুথবু-

পা নেই,শুধু পায়ের স্মৃতি পড়ে আছে।

সেই স্মৃতি ঢাকা থাকে খয়েরি চাদরে।

জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ ভাবে চাদরের রঙটা নীল হলে ভাল ছিল।

স্মৃতির রং সব সময় নীল।


অশ্রু

হুমায়ূন আহমেদ

আমার বন্ধুর বিয়ে

উপহার বগলে নিয়ে

আমি আর আতাহার,

মৌচাক মোড়ে এসে বাস থেকে নামলাম

দু’সেকেন্ড থামলাম।।

টিপটিপ ঝিপঝিপ

বৃষ্টি কি পড়ছে?

আকাশের অশ্রু ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে?

 আমি আর আতাহার

বলুন কি করি আর?

উপহার বগলে নিয়ে আকাশের অশ্রু

সারা গায়ে মাখলাম।।

হি হি করে হাসলাম।।


কাচপোকা

হুমায়ূন আহমেদ

একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকা

হাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেল।

ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর।

বিরক্ত হয়ে বলল,রোদ কেন?

আমি চাই অন্ধকার ।চির অন্ধকার

আমার ষোলটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি-

অন্ধকার দেখব বলে।

আমি চাই অন্ধকার ।চির অন্ধকার

একটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেল

বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার।

কি গাঢ়,পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার !

কাচপোকার ষোলটা ক্লান্ত পা বার বার

সেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল।

তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে

তবু সে হাঁটছে-

তাকে যেতে হবে আরও গভীর অন্ধকারে।

যে অন্ধকার-আলোর জন্মদাত্রী।


রাশান রোলেট

হুমায়ূন আহমেদ

টেবিলের চারপাশে আমরা ছ’জন

চারজন চারদিকে ; দু’জন কোনাকুনি

দাবার বোড়ের মত

খেলা শুরু হলেই একজন আরেকজনকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত ।

আমরা চারজন শান্ত, শুধু দু’জন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে ।

তাদের স্নায়ু টানটান।

বেড়ালের নখের মত তাদের হৃদয় থেকে

বেরিয়ে আসবে তীক্ষ্ম নখ ।

খেলা শুরু হতে দেরি হচ্ছে,

আম্পায়ার এখনো আসেনি।

খেলার সরঞ্জাম একটা ধবধবে সাদা পাতা

আর একটা কলম ।

কলমটা মিউজিক্যাল পিলো হাতে হাতে ঘুরবে

আমরা চারজন চারটা পদ লিখবো ।

শুধু যে দু’জন নখ বের করে কোনাকুনি বসে আছে

তারা কিছু লিখবে না ।

তারা তাদের নখ ধারালো করবে

লেখার মত সময় তাদের কোথায় ?

প্রথম কলম পেয়েছি আমি,

আম্পায়ার এসে গেছেন।

পিস্তল আকাশের দিকে তাক করে তিনি বললেন,

এ এক ভয়ংকর খেলা,

কবিতার রাশান রোলেট –

যিনি সবচে ভালো পদ লিখবেন

তাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হবে ।

আমার হাতে কলম কম্পমান

সবচে সুন্দর পদ এসে গেছে আমার মুঠোয়।

 

কব্বর

হুমায়ূন আহমেদ

তিনি শায়িত ছিলেন গাঢ় কব্বরে

যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বেঁধে দেয়া,

গভীরতা নয়।

কব্বরে শুয়ে তাঁর হাত কাঁপে পা কাঁপে

গভীর বিস্ময়বোধ হয়।

মনে জাগে নানা সংশয়।

মৃত্যু তো এসে গেছে, শুয়ে আছে পাশে

তবু কেন কাটে না এ বেহুদা সংশয়?

Next Post Previous Post