ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায় এবং যা খাবেন

 

ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায়

ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পেতে ওজন কমানো সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যাদের ওজন বেশি, তারা যদি মাত্র ৭-১০% ওজন কমাতে পারেন তবে ফ্যাটি লিভার থেকে খুব দ্রুতই মুক্তি সম্ভব।

তবে মনে রাখবেন, না খেয়ে বা কোনো মেডিসিনের মাধ্যমে খুব দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না, এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।

আপনার ওজন যেমন ১ দিনে বা ৭ দিনে বাড়েনি তাই, ওজন কমানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে সময় দিতে হবে। সঠিক খাবার গ্রহণ সেই সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত ওজন অর্জনে সহায়তা করবে।

পানি

যকৃত বা লিভার ভালো রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পানি পান করা। লিভার ভালো রাখতে অবশ্যই সঠিক পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা আবশ্যক। সুতরাং, অস্বাস্থ্যকর পানীয় যেমন কার্বোনেটেড বেভারেজ বা রাস্তার মোড়ে থাকা শরবত পানের অভ্যাস থাকলে আজ থেকে বাদ দিন এবং বিশুদ্ধ পানি পান করুন এবং আপনার যকৃতকে ভালো রাখুন।

খাদ্যভাসে পরিবর্তন আনা এবং ডায়াবেটিস ও লিপিড প্রোফাইল নিয়ন্ত্রণে রাখা

যেকোনো রোগ থেকে বাঁচার জন্য খাদ্যভাসে পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। একজন মানুষের ওজন, উচ্চতা, পরিশ্রমের ধরন, শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে নিয়মিত সুষম এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। বিভিন্ন রঙের শাকসবজি, ফল, লাল আটার রুটি বা লাল চালের ভাত এবং সঠিক পরিমাণে প্রোটিন, খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন রাখতে হবে। চিনি এবং চর্বি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।

নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস, ওজন নিয়ন্ত্রণ বা লিপিড প্রোফাইল ঠিক রাখা কোনো কঠিন বিষয় নয়। আর এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে লিভার থেকে ফ্যাট খুব সহজে দূর হবে। মনে রাখবেন, লিভার ভালো রাখতে ফিট থাকার কোনো বিকল্প নেই।

আবারও বলছি, ফ্যাটি লিভারের প্রতিরোধ ডাক্তারের হাতে না। নিজের হাতে। যেটি সবচেয়ে প্রধান চিকিৎসা সেটি হলো জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন।

কি কি খাওয়া উচিত আর কি খাবেন না

যেহেতু প্রতিটি মানুষই আলাদা, তাই একেকজনের খাবারের পরিকল্পনাও ভিন্ন হওয়া উচিত। তবে ফ্যাটি লিভারে যারা ভুগছেন তাদের লিভারের চর্বি দূর করতে স্বাস্থ্যকর চর্বি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করতে হবে।

মাছ ও সি ফুড, ফল, আস্ত শস্যদানা, বাদাম, জলপাই তেল, শাকসবজি, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি খাবার খাদ্যতালিকায় যুক্ত করুন। ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীর শরীর ইনসুলিন তৈরি করে তা ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজ জমা হয় ও লিভার সেটিকে চর্বিতে পরিণত করে।

এ কারণে স্বাস্থ্যকর চর্বি গ্রহণের মাধ্যমে শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারবে সহজেই। অর্থাৎ শরীরের কোষগুলো গ্লুকোজ গ্রহণ করতে পারবে। এক্ষেত্রে আপনার লিভারের চর্বি তৈরি ও সঞ্চয়ের প্রয়োজন নেই।

স্বাস্থ্যকর চর্বি পাওয়া যায়- ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, মাছ, মাছের তেল, উদ্ভিজ্জ তেল, বাদাম (বিশেষ করে আখরোট), তিসি, তিসি তেল ও পাতাযুক্ত সবজিতে।

লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খুব জরুরি। যখন শরীর পুষ্টিগুলো সঠিকভাবে ভাঙতে না পারে তখন কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে লিভারে চর্বি তৈরি করতে পারে।

তবে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট নামে পরিচিত যৌগগুলো কোষকে এই ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে। ব্ল্যাক কফি, সবুজ চা, রসুন, বিভিন্ন ফল, শাক সবজিসহ ভিটামিন ই জাতীয় খাবার, সূর্যমুখীর বীজ, কাজু বাদামে থাকে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট।

ভিটামিন ডি ফ্যাটি লিভার রোগে জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন ডি পেতে নিয়মিত রোদ পোহাতে হবে। কিছু দুগ্ধজাত খাবারেও পেতে পারেন এই ভিটামিন।

অন্যদিকে পটাসিয়ামও নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের সমস্যা সারায়। তাই খাদ্যতালিকায় রাখুন স্যামন ও সার্ডিনের মতো মাছ। এ ছাড়াও ব্রকোলি, মটর, মিষ্টি আলু, কলা, কিউই ও অ্যাপ্রিকটের মতো ফলসহ কিছু সবজিতেও থাকে পটাসিয়াম। দুধ ও দইয়ের মতো দুগ্ধজাত খাবারেও পটাসিয়াম বেশি থাকে।

কী কী খাবেন না?

অন্যদিকে জলপাই, বাদাম ও অ্যাভোকাডোতে থাকে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট। যা লিভারে আরও চর্বি জমায়। এ ধরনের খাবারের মধ্যে আছে- পূর্ণ চর্বিযুক্ত পনির, দই, কম চর্বি ছাড়া, লাল মাংস, পাম বা নারকেল তেল দিয়ে তৈরি বেকড পণ্য ও ভাজা খাবার।

একই সঙ্গে মিষ্টিজাতীয় খাবার যেমন- ক্যান্ডি, সোডা ও উচ্চ-ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপসহ শর্করাজাতীয় খাবার লিভারের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়।

মদ্যপানের কারণে অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এই রোগে আক্রান্ত হলে লিভারের ক্ষতি হতে পারে।

মনে রাখতে হবে, শরীরের ওজনের মাত্র ৫ শতাংশ কমালেই লিভারের চর্বি দ্রুত কমে যায়। তবে ধীরে ধীরে ওজন কমাতে হবে। প্রতি সপ্তাহে ১-২ পাউন্ডের বেশি ওজন কমানো উচিত নয়। দ্রুত ওজন কমাতে গেলে আবার লিভারে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

লিভার সুস্থ রাখতে ব্যায়াম করাও জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে কমপক্ষে ৫ দিন অন্তত ৩০-৬০ মিনিট বা তার বেশি সময় ধরে শরীরচর্চা করুন। একই সঙ্গে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পাশাপাশি কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডও নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

ফ্যাটি লিভার হলে কি সমস্যা হয়

লিভারে চর্বি জমলে স্বাভাবিক কাজ কিছুটা ব্যহত হয়। খাওয়ার ইচ্ছে কমে যায়, খাবারে অরুচি হয়, দ্রুত ওজন কমা, বমি বমি ভাব, বমিও হওয়া, খুব দুর্বল লাগা ও কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না। ফ্যাটি লিভার হলে মাথাব্যথা, মন খারাপ ও ডিপ্রেশন, আচমকা কাঁপুনিসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়।

ফ্যাটি লিভারের হোমিও ঔষধ

হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়, যা বহু গবেষণার পর রোগের লক্ষণ গুলি বিবেচনা করে রোগীকে দেওয়া হয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা খুব জনপ্রিয়। এই প্রতিকারে প্রত্যেকের লক্ষণ আলাদা ভাবে বিবেচনা করার পরই কোন সার্বিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। হোমিওপ্যাথি ফ্যাটি লিভারের সমস্ত লক্ষণ গুলির প্রতিকার করতে দক্ষ এবং এই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে পুনরায় ফিরে আসতে দেয় না।

ফ্যাটি লিভারের জন্য কিছু সাধারণ হোমওপ্যাথি ঔষধ

চেলিডোনিয়াম- পেটের ডান দিকে অস্বাভাবিক ব্যথা যা ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ, তা নির্মূল করতে এটি সহায়ক। এই ক্ষেত্রে, লিভারের আকার বেড়ে যায় এবং রোগী কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি বমি এবং বমির সমস্যায় ভোগেন। এবং রোগীর মধ্যে অত্যাধিক দুর্বলতা দেখা যায় এবং গরম খাদ্য ও পানীয় খাবার ইচ্ছা রাখে।

লাইকোপডিয়াম- যদি গ্যাস বা অম্লতার সমস্যার জন্য ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা যায় তাহলে সেক্ষেত্রে এটি খুব উপকারী। এই ক্ষেত্রে রোগীর পেটের সমস্যা এবং জ্বালাভাব অনুভব করেন। এই ক্ষেত্রে রোগীর সন্ধ্যার দিকে শরীর খারাপ হয়ে যায় এবং মিষ্টি জাতীয় বা গরম পানীয় খেতে ইচ্ছা করে।

ফসফরাস- এটি সেই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যখন ঢেকুরের সাথে ফ্যাটি অ্যাসিড বের হয়। অনেক সময় রোগী এক্ষেত্রে পেটে ব্যথা অনুভব করে। এর সাথে বমি হয় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।

ক্যালকেরিয়া কার্ব- মোটা রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগের চিকিৎসা করা হয় ক্যালকেরিয়া কার্ব দিয়ে। এইসব মানুষের পেট ভার হয়ে থাকে, ল্যাকটোজের সমস্যা হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা থাকে। এরা সবসময় ঠাণ্ডা জায়গায় থাকতে ভালোবাসে এবং প্রচণ্ড ঘেমে যায়।

নাক্সভোমিকা- যে ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে কোন কিছুখাওয়ার পর পেট ব্যথা হয় তার প্রতিকার হিসাবে নাক্সভোমিকা ব্যবহার করা হয়।

অত্যাধিক অ্যালকোহল খাওয়ার জন্য যে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা দেয় এবং সেক্ষেত্রে পেট ব্যথাও হয় সেই চিকিৎসার জন্য নাক্সভোমিকা খুব উপকারী। এই ধরণের রোগীর কোন কিছু তেতো খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার পড়ে পেটে ব্যথা শুরু হয়। তাদের ক্রমাগত মল বের করার অনুভূতি পায় কিন্তু তারা তা করতে পারে না। হোমওপ্যাথি ঔষধ যদি কম পরিমাণে গ্রহন করা হয় তাহলে তার কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না, কিন্তু কখনওই নিজে থেকে কোন ঔষধ গ্রহন করা উচিৎ নয়। আপনি যদি ফ্যাটি লিভারের সমস্যায় ভোগেন, তাহলে দ্রুত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন যে আপনার রোগ অনুযায়ী আপনার সঠিক চিকিৎসা করবে।

Next Post Previous Post