জীবন নিয়ে সেরা সব কবিতা
চলুন জীবনকে কবিতার মাধ্যমে দেখি...
জীবন নিয়ে কবিতা
আমরা সকলেই
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের হারানো দিনের-গল্প বলে গেলো
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের উঠতে বললো না
কেবল বললো বসে বসে শোনো তোমরা
তোমাদের সেই দিনগুলি যা তোমরা পিছনে ফেলে রেখে এসেছিলে
তা কেউ কুড়িয়ে নেয়নি আর
তুমি টাকা হারিয়ে এসো, পিছন থেকে কুড়িয়ে নেয় অনেকে
পথ হারিয়ে এসো তুমি, সে-পথেই সারিবদ্ধ পথিক চলেছে
মৃতদেহ ফেলে রেখে এসো তুমি, — শকুন শৃগালে ভোগ করেছে মাংস
দরজা খুলে রেখে এসো তুমি—ত্রস্ত মেয়েমানুষ নিয়েছে পিতলের বাসন
বাড়ি ফেলে রেখে এশো তুমি— সমস্ত নৈরেকার, সকলি নৈরেকার !
তুমি ছেঁড়া জামা দিয়েছো ফেলে
ভাঙা লন্ঠন, পুরোনো কাগজ, চিঠিপত্র, গাছের পাতা—
সবই কুড়িয়ে নেবার জন্যে আছে কেউ
তোমাদের সেই হারানো দিনগুলি কুড়িয়ে পাবে না তোমরা আর |
তোমরা যতো যাবে ততোই যাবে মৃত্যুর দিকে
বোঝাবে সকলে – ঐ তো জীবন, ঐ তো পূর্ণতা, ঐ তো সর্বাঙ্গীন সর্বাবয়ব
ঐ তো যাকে বলে সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য, ধ্যান, পরমার্থ বিষাদ—
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের হারানো দিনের গল্প বলে গেলো
তারা কোথা থেকে পেয়েছো বলে গেলো না
স্বীকার করলো না তারা পথ থেকে চুরি করেছে কিনা আমাদের
সেই হারানো স্বপ্নগুলি, স্মৃতিগুলি
তারা আমাদের বলে গেলো হারানো দিনের সেই অনুপম স্বপ্নগুলি স্মৃতিগুলি
আমরা অনুভব করলাম আবার—সেইসব হারানো গল্প
যা আমরা এতাবত্কাল হারিয়ে এসেছি
হারিয়ে এসেছি বনে-প্রান্তরে পুরানো খাতার শ্লেটে রাসতলায়
নদীসমুদ্রে বেলাভূমিতে পথে ডালে-ডালে টকি হাউসে
হারিয়ে এসেছি ইস্টিশানে খেয়াঘাটে কলকাতার গ্রামে গ্রামে
কারুর চুলে কারুর মুখে চোখে কারুর অঙ্গীকারে—
হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি – ফিরে পাবো না
জেনে কখনো আর
কখনো ফিরে পাবো না সেইসব দিন যা ঝড়-বৃষ্টি-রৌদ্রে হেমন্তে ভরা
সেইসব বাল্যকালের নগ্নতার কান্নার পয়সা-পাবার-দিন
ফিরে পাবো না আর
ফিরে পাবো না আর কাগজের নৌকা ভাসাবার দিন উঠানের
ক্ষণিক সমুদ্রের কলরোলে
ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর
সেইসব জ্যোত্স্নার ঝরাপাতার কথকতার দিন ফিরে পাবো না আর |
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের সেইসব হারানো দিনগুলির
কথা বলে গেলো
সকালবেলা তাই আমাদের কোনও কাজ হয়নি করা
আমরা অনন্তকাল এমনি চুপচাপ হারানো দিনের গল্প শুনছিলাম
পুলিশের মতো
আমরা আমাদের কর্তব্য স্থির করছিলাম পুলিশের মতো
আমরা ভাবছিলাম সেইসব হারানো দিনগুলি ফিরে পাবার জন্য
লাকি মিতাকে পাঠিয়ে দেখবো একবার
আমরা বসে বসে এলোমেলো উত্তাল সম্ভাবনার স্বপ্নে এমনি করে
ব্যস্ত রাখছিলাম আমাদের
আমরা এমনি করে সময়ের একের পর এক চড়াই-উৎরাই হচ্ছিলাম পার
এমন সময় তারা বললো—‘গাড়ি’ এসে গেছে, উঠে পড়ো উঠে পড়ো –
এখানে থাকলে বাঘে খাবে তোমাদের’
আমরা তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে
ভবিষ্যৎ-গাড়ির দিকে চলে গেলাম
আমরা সকলেই এখানে বাঘের জিহ্বা এড়িয়ে গিয়ে ওখানের বাঘের
জিহ্বার দিকে চলে গেলাম।
------------------------
অতিজীবিত
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
বাগানের গাছটিও বাড়বে রোদ্দুরে বৃষ্টিতে
আমার ফুল ফুটবে তুমি সৌরভ পাবে না
পুকুর ভাসবে সবুজপানায় নিরুত্সুক দ়ৃষ্টিতে
মুখ আমার ভাসবে আলোয় গৌরব পাবে না
একা-একাই তোমার বোনা গাছটি দেখবো ফুলটি দেখবো
বাগানে কোনো বড় গভীর ছায়ার তলায় ঘুমিয়ে পড়বো
জল আসবে বৃষ্টি আসবে ভাসবে দেহ সে-ও আসবে
শশাকুচির আমবাগানে তোমার স্পর্শ রাখবে না।
নতুন হাত নিড়ুনি করবে এধার-ওধার দু-চারটি ঘাস
পুঁই তুলবে, মাচা বাঁধবে কুমড়োলতা মাখবে না
পুরোনো নষ্ট শর্করায় নতুন কালো গাভীর পীযূষ
আমি মানবো সাপটে ধরবো নতুন বাগান, নতুন গাছটি
বেঁচে উঠবো সরল ঋজু রোদ্দুরে বৃষ্টিতে।
------------------------
অবসর নেই – তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
তোমাকে একটা গাছের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো
সারা জীবন তুমি তার পাতা গুনতে ব্যস্ত থাকবে
সংসারের কাজ তোমার কম—‘অবসর আছে’ বলেছিলে একদিন
‘অবসর আছে – তাই আসি |’
একবার ঐ গাছে একটা পাখি এসে বসেছিলো
আকাশ মাতিয়ে, বাতাসে ডুবসাঁতার দিয়ে সামান্য নীল পাখি তার
ডানার মন্তব্য আর কাগজ-কলম নিয়ে বসেছিলো
‘হ্যাঁ, আমি তার লেখাও পেয়েছি |’
ক্কচিৎ কখনো ঐ পথে পথিক যায়
আমায় এসে বলে—‘বেশ নির্ঝঞ্ঝাট আছো তুমি যাহোক !’
আমার হিসাবনিকাশ, টানাপোড়েন, আমার সারাদিন
‘অবসর নেই—তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না |’
সন্ধে হয়, ইস্টিশানের কোমরের আকন্দ ফুলগুলি ফুটে ওঠে
আমার কষ্ট হয় কেমন
আকন্দ-র নাকছাবি তোমায় মানাতো বেশ
পাতার একটা থোক হিসেব পাঠাতে তত্পর হয়ো—
‘তাছাড়া, কম দিন তো হলো না তুমি গেছো !’
দুপুররাতের কথা তোমাদের কিছু কানে গেছে
জ্যোত্স্নায় গাছের ভিতরে পা ছড়িয়ে বসো তুমি
‘গতমাসে একটা রান্নাঘর তৈরি হবার কথা জানিয়েছিলে
হোটেলের ভাত-ডাল তাহলে আর তেমন পুষ্টিকর নয় ?’
জীবনে হেমন্তেই তুমি ছুটি পাবে—
পুরীতেও যেতে পারো—ফিরতি পথে
ভুবনেশ্বরটাও দেখে এসো,
আবার কবে যাও না-যাও ঠিক নেই –
আমার হিসাবনিকাশ টানাপোড়েন, আমার সারাদিন
‘অবসর নেই—তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না।’
------------------------
চাবি
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরংগ আজ খোলো?
থুতনিপরে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাত্ লিখতে হলো ।
চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো –
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কিনা?
অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরত্ চাহো কি না?
------------------------
আমরা তো অল্পে খুশি
জয় গোস্বামী
আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।
চলে যায় দিন আমাদের
অসুখে ধারদেনাতে
রাত্তিরে দুভায়ে মিলে
টান দিই গঞ্জিকাতে।
সবদিন হয়না বাজার,
হলে হয় মাত্রাছাড়া –
বাড়িতে ফেরার পথে
কিনে আনি গোলাপচারা।
কিন্তু পুঁতব কোথায়?
ফুল কি হবেই তাতে?
সে অনেক পরের কথা
টান দিই গঞ্জিকাতে।
আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।
মাঝে মাঝে চলেও না দিন
বাড়ি ফিরি দুপুররাতে ;
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়
নুন নেই ঠান্ডা ভাতে।
রাগ চড়ে মাথায় আমার
আমি তার মাথায় চড়ি,
বাপব্যাটা দুভায়ে মিলে
সারা পাড়া মাথায় করি।
করি তো কার তাতে কী?
আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের ভাতের পাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।
------------------------
ব্যস্ততা
তসলিমা নাসরিন
তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, যা কিছু নিজের ছিল দিয়েছিলাম,
যা কিছুই অর্জন-উপার্জন !
এখন দেখ না ভিখিরির মতো কেমন বসে থাকি !
কেউ ফিরে তাকায় না।
তোমার কেন সময় হবে তাকাবার ! কত রকম কাজ তোমার !
আজকাল তো ব্যস্ততাও বেড়েছে খুব।
সেদিন দেখলাম সেই ভালবাসাগুলো
কাকে যেন দিতে খুব ব্যস্ত তুমি,
যেগুলো তোমাকে আমি দিয়েছিলাম ৷