ধনে পাতার উপকারিতা এবং এর ক্ষতিকর দিক

 

ধনে পাতার উপকারিতা

ধনে পাতার উপকারিতা অনেক। ধনে পাতা পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুব কমই আছে। সুপরিচিত পাতা অসাধারণ পুষ্টিগুন ভরপুর। ধনেপাতা একটি সুগন্ধি ঔষধি গাছ। 

ধনিয়া পাতার বৈজ্ঞানিক নাম Coriandrum sativum. এটি একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র ধনের বীজ খাবারের মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সুস্বাদু ধনের পাতা বাংলাদেশী চাটনি ও মেক্সিকান সালসাতে ব্যবহার করা হয়। ধনে পাতাকে আমরা সালাদ এবং রান্নার স্বাদ বাড়ানোর কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু শুধু স্বাদ এবং ঘ্রাণ বাড়ানোর কাজেই এর গুণাগুণ শেষ হয়ে যায় না। এ পাতা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো একটি তৃণ জাতীয় খাবার।

অধিকাংশ মানুষ ধনে পাতার উপকারিতা না জেনেই নিয়মিত বিভিন্ন তরকারিতে ব্যবহার করে আসছে। এতে রয়েছে ১১ জাতের এসেনশিয়াল অয়েল তন্মধ্যে লিনোলেয়িক এসিড, লিনোলেনিক এসিড, স্টিয়ারিক এসিড, পামিটিক এসিড ইত্যাদি অন্যতম। এতে রয়েছে ফাইবার। 

ভিটামিন সমূহের মধ্যে এতে রয়েছে, ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘কে’, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন ইত্যাদি। মিনারেলের মধ্যে রয়েছে ম্যাংগানিজ, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন এবং জিংক, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমানে পলিফেনল ও ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটিতে কোলেস্টেরল এর মাত্রা শূন্য। তাই এ পাতাকে সাধারণ কিছু ভাবার কোনো কারণ নেই।

ধনে পাতার উপকারিতা 

  • ধনে পাতা খেলে শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়।

  • হজমে উপকারী, যকৃতকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। ধনে পাতা খেলে পেট পরিষ্কার হয়ে যায়।

  • ধনে পাতার ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ‘এ’ ফুসফুস এবং পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধে কাজ করে।

  • এতে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান যা বাতের উপশমে কাজ করে।

  • ধনে পাতা স্মৃতিশক্তি প্রখর এবং মস্তিষ্কের নার্ভ সচল রাখতে সাহায্য করে।

  • ধনে পাতার ভিটামিন ‘কে’ অ্যালঝাইমার রোগের চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী।

  • ধনে পাতার সিনিওল এসেনশিয়াল অয়েল এবং লিনোলিক অ্যাসিড থাকে যার মধ্যে অ্যান্টি-রিউম্যাটিক এবং অ্যান্টি- আথ্রাইটিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এরা ত্বকের জ্বালাপোড়া এবং ফুলে যাওয়া কমাতে সাহায্য করে।

  • ডিসইনফেকট্যান্ট, ডিটক্সিফাইং বা বিষাক্ততা রোধকারী, অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকার কারণে বিভিন্ন স্কিন ডিজঅর্ডার বা ত্বকের অসুস্থতা ( একজিমা, ত্বকের শুষ্কতা এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন) সারাতে সাহায্য করে। ত্বক সুস্থ ও সতেজ রাখতে তাই ধনে পাতার উপকারিতা অনেক।

  • ক্যালশিয়াম আয়রন এবং কলিনার্জিক বা অ্যাসেটিকোলিন উপাদান মিলে আমাদের শরীরে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখে।

  • কারও মুখে যদি দুর্গন্ধ হয় বা অরুচি লাগে তাহলে ধনে পাতা ভাজা করে বোতলে ভরে রাখুন। মাঝে মাঝে চিবিয়ে খান মুখে দুর্গন্ধ থাকবে না।

  • প্রতিদিন ধনেপাতার শরবত খেলে কিডনির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কিডনির মধ্যে জমে থাকা ক্ষতিকর লবন এবং বিষাক্ত পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।

  • ধনে পাতা খেলে শরীরে খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা কমে যায়, ভালো কোলেস্টরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। হজমে উপকারী, যকৃতকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে এবং পেট পরিষ্কার হয়ে যায় ধনে পাতা খেলে।

  • ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্য ধনেপাতা বিশেষ উপকারী একটি খাবার। এটি ইনসুলিনের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং রক্তের সুগারের মাত্রা কমায়। ধনে পাতায় থাকা অ্যান্টি-সেপটিক মুখে আলসার নিরাময়েও উপকারী, চোখের জন্যও ভালো।

  • ঋতুস্রাবের সময় রক্তসঞ্চানল ভাল হওয়ার জন্যে ধনেপাতা খেলে উপকার পাওয়া যায়। এতে থাকা আয়রন রক্তশূন্যতা সারাতেও বেশ উপকারী। ধনে পাতার ফ্যাট স্যলুবল ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন ‘এ’ ফুসফুস এবং পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে।

  • এতে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান, যা বাতের ব্যথাসহ হাড় এবং জয়েন্টের ব্যথা উপশমে কাজ করে। স্মৃতিশক্তি প্রখর এবং মস্তিস্কের নার্ভ সচল রাখতে সাহায্য করে ধনেপাতা।

  • ধনেপাতায় উপস্থিত সিনিওল এসেনশিয়াল অয়েল এবং লিনোলিক অ্যাসিড থাকে যার মধ্যে অ্যান্টিরিউম্যাটিক এবং অ্যান্টি-আর্থ্রাইটিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এরা ত্বকের জ্বালাপোড়া এবং ফুলে যাওয়া কমাতে সাহায্য করে।

  • অ্যান্টি হিস্টামিন উপাদান থাকায় এরা অ্যালার্জি বা এর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে দূরে রাখে। ধনেপাতার মধ্যে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিইনফেকসাস, ডিটক্সিফাইং, ভিটামিন ‘সি’ এবং আয়রন গুটিবসন্ত প্রতিকার এবং প্রতিরোধ করে।

  • মধুজাতীয় খাবারের সাথে ধনেপাতার মিশ্রন মানুষের যৌনশক্তি প্রাকৃতিকভাবে বৃদ্ধি করে। মুখের দুর্গন্ধ ও অরুচি ভাব দূর করে ধনে পাতা। এছাড়া শুকনো ধনেও একই কাজ করে। মাঝে মাঝে ধনেপাতা চিবিয়ে খান, মুখের দুর্গন্ধ থাকবে না।

  • কারও মাথাব্যথা হলে ধনে পাতা ও গাছের রস কপালে লাগান। মাথাব্যথা কমে যাবে। ধনে পাতা চিবিয়ে দাঁত মাজলে দাঁতের মাড়ি মজবুত হয় এবং দাঁতের গোড়া হতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।

ধনে পাতা খাওয়ার ক্ষতিকর কিছু দিক 

রোজকার একঘেয়ে রান্নায় একটু খানি ধনে পাতা। ব্যাস স্বাদ -গন্ধ দুটোই এক নিমেষে বদলে যায়। ধনেপাতার বৈজ্ঞানিক নাম কোরিয়েন্ড্রাম সেটিভা। আসলে ধনেপাতার বিভিন্ন ওষধি গুণ থাকার পাশাপাশি কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করলেও স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকরও এই ধনে পাতা। আসুন জেনে নেই ক্ষতিকর দিকগুলো।

লিভারের ক্ষতি 

অতিরিক্ত ধনেপাতা খেলে এটি লিভারের কার্যক্ষমতাকে খারাপভাবে প্রভাবিত করে থাকে। এতে থাকা এক ধরনের উদ্ভিজ তেল শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে ফেলে। এছাড়া এটাতে এক ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে, যেটা সাধারণত লিভারের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে। কিন্তু দেহের মধ্যে এর অতিরিক্ত মাত্রার উপস্থিতি লিভারের ক্ষতিসাধন করে।

নিম্ন রক্তচাপ সৃষ্টি 

অতিরিক্ত ধনেপাতা খাওয়ার ফলে হৃৎপিন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি নিম্ন রক্তচাপ সৃষ্টি করে। চিকিৎসকরা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ধনেপাতা খাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে অতিরিক্ত খেলে সেটা নিম্ন রক্তচাপের সৃষ্টি করে। এছাড়া এটি মাথাব্যথারও কারণ হতে পারে।

পেট খারাপ 

স্বাভাবিকভাবে ধনেপাতা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল বিষয়ক সমস্যা দূর করে থাকে। কিন্তু বেশি পরিমাণে ধনেপাতা খেলে পাকস্থলীর হজমক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করে। এক গবেষণা বলছে, সপ্তাহে ২০০ গ্রামের বেশি ধনেপাতা খেলে তা গ্যাসের ব্যথা, পেটে ব্যথা, পেট ফোলা, বমি হওয়া এমনকি ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।

শ্বাসকষ্ট বাড়ায় 

শ্বাসকষ্টের রোগীদের ধনেপাতা খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেন চিকিৎসকরা। কেননা এটি শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা করে। যার ফলে ফুসফুসে অ্যাজমার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। শ্বাসকষ্টের রোগীরা ধনেপাতা খেলে ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিতেও সমস্যা তৈরি হয়।

বুকে ব্যথা 

অতিরিক্ত ধনেপাতা খেলে বুকে ব্যথার মত জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটা শুধুমাত্র অস্বস্তিকর ব্যথাই সৃষ্টি করে না তা দীর্ঘস্থায়ীও করে।এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে দৈনন্দিন আহারে কম পরিমাণে ধনেপাতা খেতে পারেন।

ত্বকের সংবেদনশীলতা 

সবুজ ধনেপাতাতে মোটামুটিভাবে কিছু ঔষধি অ্যাসিডিক উপাদান থাকে যেটি ত্বককে সূর্যরশ্মি থেকে বাঁচিয়ে সংবেদনশীল করে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত সেবনে সূর্যের রশ্মি একেবারেই ত্বকের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ত্বক ভিটামিন ‘কে’ থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া ধনেপাতা ত্বকে ক্যানসারও তৈরি করে থাকে।

অ্যালার্জির সমস্যা 

ধনেপাতার প্রোটিন উপাদানটি শরীরে আইজিই নামক অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানকে সমানভাবে বহন করে থাকে। কিন্তু এর অতিরিক্ত মাত্রা উপাদানগুলোর ভারসাম্য নষ্ট করে। ফলে অ্যালার্জীর তৈরি হয়। এই অ্যালার্জীর ফলে দেহে চুলকানি, ফুলে যাওয়া, জ্বালাপোড়া করা ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করে।

মুখ ব্যথা  

অতিরিক্ত ধনেপাতা খাওয়ার আর একটি ক্ষতিকর দিক হল মুখে ব্যথা হওয়া। ধনেপাতায় বিভিন্ন এসিডিক উপাদান রয়েছে, যা ত্বককে সংবেদনশীল করে থাকে। পাশাপাশি এটি মুখে প্রদাহেরও সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ঠোঁট, মাড়ি এবং গলা ব্যথা হওয়া। সারা মুখ লালও হয়ে যেতে পারে।

ভ্রূণের ক্ষতি 

নারীদের গর্ভকালীন সময়ে অতিরিক্ত ধনেপাতা খাওয়া ভ্রূণের বা বাচ্চার শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকারক। ধনেপাতাতে থাকা কিছু উপাদান নারীদের প্রজনন গ্রন্থির কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে ফেলে। যার ফলে নারীদের বাচ্চাধারণ ক্ষমতা হৃাস পায়। বাচ্চাধারণ করলেও গর্ভকালীন ভ্রূণের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

Next Post Previous Post